এ লেখা তোমার কাছে যাবে, তুমি পড়বে, এ ভ্রমে আমি নেই। তবু যদি এই উড়োচিঠি হাজির হয় তোমার কাছে কোনোদিন, কোনোভাবে – নিজে থেকে শুধু মেসেজ কোরো ‘পড়েছি’। আমি তার পরিপ্রেক্ষিতে তোমায় কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে বিব্রত করব না। অর্ক, ভালবাসা তো প্রকাশ পেতে চায়। পৌঁছাতে চায় গন্তব্যে। অনেকের ভালবাসা সে পথে হাঁটা শুরুই করে না। আমাদের করেছিল। আমি বিশ্বাস করি করেছিল। কিন্তু মাঝপথে যেই হারিয়ে ফেলার কষ্ট তো যাওয়ার নয়। তবু তুমি ‘পড়েছি!’ জানালে, জানব, একসাথে না হোক, আমরা কোনো একভাবে গন্তব্যে পৌঁছলাম। ... ...
ঠাকুমার মতন আরও শত শত স্পর্শে গায়ে কাঁটা দিল রথের, রথের রশির। তাতেই নড়েচড়ে চলতে শুরু করলেন তালধ্বজ, দেবদলন এবং নন্দীঘোষ। রথ, পথ আর মূর্তি অন্তর্যাপন করলেন আমার, তোমার এবং সকলের। ঐশ্বরিক হয়ে উঠল গায়ে লেগে থাকা সময়টুকু। জনজোয়ারের প্রবল উচ্ছাসে ঢেকে গেল জন্মমৃত্যু। তাদের গায়ে তখন সূর্যের মতন তেজ। প্রবল বৃষ্টি তাঁর কাছে এসে ইলশেগুঁড়ি হয়ে যায়। আল্পনা এঁকে যায় রশির গায়ে সাতরঙা রোদ। রামধনু হয়ে ওঠে জনজোয়ার, আনন্দতরঙ্গ তোলে আমাদের বুক ছাপিয়ে। লক্ষ লক্ষ রোদের কণা, বৃষ্টির ছাঁট আর প্রজন্মব্যাপী আনন্দস্পর্শ রামধনুর ভার বয়ে নিয়ে চলে। তাঁকে টানতে হয় না আলাদা করে। কেবল ছুঁয়ে পথ চলতে হয়। ... ...
জানতাম না LGBT+ কাকে বলে। শুধু জানতাম একটি শব্দ ‘Gay’ আর এটাও জানতাম যে আমাকে সবসময় প্রমাণ করতে হবে যে আমি কোনো অবস্থাতেই Gay নই ... “এই বেটা, বেটিন্তর মতো হাটস কিতা, বুক ফুলাইয়া হাট” (মেয়েদের মতো হাঁটছিস কেন, বুক ফুলিয়ে হাঁট), বাবার এই কথাগুলো এখনো মাঝে মাঝে কানে বাজে। বা বোনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটু রূপচর্চা করলে বাবা যখন বলতেন, “দুনিয়ার যত বেটিয়ামী কাম তোর” (পৃথিবীর সব মেয়েলোকের কাজ তোকে করতেই হয়) তখন মনের অজান্তেই একটা প্রশ্ন জাগত, কেন আমি এমন। কেন আমি এত হাত নাড়িয়ে কথা বলি, কেন আমার ছেলেদের শরীরের কাছঘেঁষা হয়ে থাকতে ভাল লাগে, কেন আমি ছেলেদের মত হাঁটতে পারি না। ... ...
এক জানালা বৃষ্টির সামনে সেদিন অনুষ্ঠান হবে। যারা মোটা করে কাজল পরে আসবে, সকলে কাঁদবার সুযোগ পাবে। এক-এক করে গিয়ে দাঁড়াতে হবে জানালায়। চোখের কালো জল মিশে যাবে কার্নিশে। সম্পূর্ণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার আগে অবধি পড়া হবে জয় গোস্বামী। তারপর ব্যথাগুলোকে একটা কাচের প্লেটে করে কিছুক্ষণ রাখা হবে শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার স্টিক-এর পাশে। সমান করে দু’দিক কেটে সেলাই করা হবে। সাইকেল থেকে পড়ে গেলে, ওটাই শুধু ব্যথা হলে, কত ভালো হত। ‘ওর সাথে আর কোনোদিন কথা হবেনা’-র সাথে ‘বাড়ি থেকে কোনোদিন মেনে নেবে না’-কে সমান করে সেলাই করবি। দু’দিকের দুটো হাতা হয়ে যাবে। বোতামের ঘাট রাখিস। দুটো করে বোতাম দিবি, ভিতরের দিকে ‘পাড়ার লোক কী বলবে’, আর বাইরের দিকে ‘বড়রা যা বলে ভালর জন্য’। ... ...
আমার দুটো ঘর। একটাতে আমরা কয়েকজন মিলে থাকি, অন্যটায় পৌঁছতে হয় একা একা। যে ঘরটায় অনেকে মিলে থাকি, সেখান থেকে বার হয়ে অন্য ঘরে পৌঁছতে হলে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়... ... ...
“কী রে, তোর বিয়েতে কবে খাব... ???” এই প্রশ্ন তো সয়ে গেছে এবং আমি বেশ ইনোভেটিভ উত্তরও দিই। তার ভয়ে আর কেউ এই কথা আর তোলে না। তবে একটা জিনিস অনুভব করি – যেটা আজকাল বেশ মনে হয়; সেটা হল একটা অদ্ভুত exclusion – অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার একটা অনুভূতি ... আরও কেমন লাগে, যখন দেখি, যে সেই বিবাহিত জুটিদের নিজেদের মধ্যেকার হাসা-হাসি-ইয়ার্কি, সেখানেও সেই exclusion-এর একটা অনুভূতি। অথচ আমার মনে কিন্তু একটা অপূর্ণ সাধ রয়েই গেছে – বিয়ে করার, ঘর বাঁধার – এইসব শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি শুনলে এই ইচ্ছেগুলো বেশ নড়েচড়ে ওঠে, নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়, মন কেমন করিয়ে তোলে। ... ...
আমার বন্ধুদের মধ্যে যেন বোমা পড়ল। কেউ ভাবতে পারেনি আমি ওই সম্পর্কে কখনও থাকব না, এমন হতে পারে। আর কারণটা জানাতে শুরু করলাম সবাইকেই, কিছু না লুকিয়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। সমকামী ও রূপান্তরকামী নারীপুরুষ সকলে। একটা অদ্ভুত জগৎ। সবটার সঙ্গে নিজেকে না মেলাতে পারলেও, চেষ্টা করতাম – যতটা পারা যায় জ্ঞান সঞ্চয় করতে। মনে হত, আর কোনও পরীক্ষা কি আছে, যা থেকে বোঝা যাবে আমি কী? আমার তো কোনও সমকামী সম্পর্কও নেই। কী করে প্রমাণ দেব, যে আমি সমকামী? কী করে বাকিদের বোঝাব, যে আমার সম্পর্ক ভাঙার আর কোনও কারণ নেই এটা ছাড়া? কী করে জাস্টিফাই করব আমার দাবি? ... ...
২০০১ সালে যখন প্রথম queer rights নিয়ে সক্রিয় হই, তখন আমি ১২ ক্লাসের ছাত্র। সবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়েছি। তারপর ২০০৩-০৪ সালে প্রথম ডকুমেন্টারি ছবি “পিকু ভাল আছে”। শহরের কাগজে কাগজে রিভিউ আর কলেজ, ঘর, পাড়ার কোণায় কোণায় উৎসহিষ্ণু, অবাক, বিদ্রূপাত্মক চোখ – ছেলেটা কী বলে রে বাবা! এমনকি শহরের closeted গে, লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল মানুষেরাও internalised phobia থেকে থু থু করে উঠল – “দিব্বি ছিলাম বাপু, ৩৭৭ ধারা থেকে বেঁচে, ক্যাসুয়াল ডেট করে। দিল সব ফাঁস করে”। ... ...
লজিবিটিকিউ দের নিয়ে লিখতে বা বলতে গিয়ে আমরা অবচেতনে অনেক সময়ই কিউ শব্দটা এড়িয়ে যাই। আমরা সমকামীদের নিয়ে লিখি-টিখি, কিন্তু এই কিউ বা কুইয়ার, বাংলা করলে যার প্রতিশব্দ 'উদ্ভট'এর কাছাকাছি, সেটাকে ছুঁই না। কারণ, যে ব্যাপারটা নামেই উদ্ভট, তার মধ্যে ঢোকা কঠিন। কে জানে কী জটিলতায় জড়িয়ে যাব। ওই কারণেই, ঘোষিত ভাবেই যাঁরা কুইয়ার, তাঁদের নিয়ে তেমন লেখাপত্র চোখে পড়েনা। তার চেয়ে কোনো একটা নির্দিষ্ট খোপে ঢুকে থাকা নিরাপদ। সমকামিতা এখনও, সমাজে পুরোপুরি গৃহীত নয়। কিন্তু তবুও সেটা নিয়ে লেখা সহজ, যখন পুরুষ চায় পুরুষকে, অথবা নারী কামনা করে নারীকে -- এরকম এক বোধগম্য সুনির্দিষ্ট খোপ আছে। উভকামিতা বা বিষমকামিতাও তাই। কিন্তু বাকিটুকু তো কেমন তরল, ধোঁয়ায় ঢাকা, যেন পাহাড়ের গায়ের কুয়াশা, যেখানে এদিক-সেদিক থেকে কখন কোন পাইনবন উঁকি মারবে বোঝা দুষ্কর। এ কুয়াশা যেন রহস্যময়। কোনো পাত্রে আঁটানো অসম্ভব। কোনো আকার দেওয়া কঠিন। ... ...
অব্যর্থ আর অমোঘ শব্দ, শব্দের পর শব্দগুচ্ছ যা জন্ম নিতে পারে কেবল গভীর নৈঃশব্দের মধ্যে আর তাকে রঙে রূপে সাকার করা ছবির পর ছবি। এই যুগলবন্দীর পেছনে যাদের মনন আর শিল্পচেতনা তারা আমার থেকে তো বটেই অনেকের থেকেই অনেক বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষ, একথা স্বীকারে আমার কোনো লজ্জা নেই। অর্চন মুখার্জির তোলা সব অসাধারণ ফোটোগ্রাফ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়ে তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তা যে এমনি এমনি নয়, নৈশঃব্দের শব্দগুচ্ছে পাতার পর পাতায় তার অকাট্য প্রমাণ। ভাবনা পরিকল্পনাও তার। আর কথা? নিচের উদ্ধৃতি টুকু পড়ুন। তৃতীয় পরিসরের মানুষের গোটা জীবন কতো অল্প কথায়, কী অপরিসীম ব্যঞ্জনায় বিধৃত হয়ে আছে অভিজিত মজুমদারের কলমে !! ... ...
মেয়েটির মায়াময় মুখ এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কন্ঠস্বরও। - ওই নেকুপুষুমনু শব্দ অনেকবার শুনেছি স্যার। আমাদের গাড়ির কাছে আসতে দেখলেই কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে মিথ্যে ফোনে ব্যস্ত হন সাহেব-মেম, নয়তো কপালে হাত ঠেকিয়ে মাফ করতে বলেন... ফাটা নোট চালিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসে লোকে। হলদে, সাদা, লাল – কোন গোলাপই নই স্যার। আমরা হলাম শল্লকী... সারা গায়ে কাঁটা গাঁথা শজারু। নিজের মা সকালে উঠে আমার আর ভাইয়ের মুখ দেখত না। সোজা গোয়াল ঘরে গিয়ে এঁড়ে, বকনা – যা হয় দেখে আসত – এদের কি দোষ। ... ...
আজ ‘যৌনকর্মী’ কথাটা উচ্চারণ যতটা সহজ লাগে নব্বইয়ের দশকে তা ছিল না। আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নব্বইয়ের দশকে এইডস মহামারী সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। রোগটা ছড়াচ্ছিল মূলত যৌনকর্মীদের যৌনরস ও রক্ত থেকে, তাঁদের থেকে অন্যেরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন, অন্যের থেকে তাঁরাও আক্রান্ত হচ্ছিলেন। এই রোগকে বাগে আনতে ১৯৯২ সালে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর তরফে এসটিডি/এইচআইভি ইন্টারভেনশন প্রজেক্ট-এর ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব এসে পড়ে স্মরজিৎদার উপর। এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লি সোনাগাছিতে শুরু হয় ‘সোনাগাছি প্রজেক্ট’। কিন্তু কাজ শুরু করার কিছুদিন পর তাঁর মনে হয়েছিল, শুধু প্রচারের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের শিক্ষিত করে, আক্রান্তের চিকিৎসা করে এইসব রোগের সংক্রমণ থামানো যাবে না। যৌনকর্মীদের কালেক্টভ বার্গেইনিং পাওয়ার না বাড়াতে পারলে এইডস বা সিফিলিস, গনোরিয়ার মত সেক্সচুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিস (এসটিডি) কমানো যাবে না। সংক্রমণ বাগে আনতে গেলেও যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যৌনকর্মে কন্ডোম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই পর্যন্ত তাঁর ভাবনা ছিল বিশেষজ্ঞের। এ কথা বলে তিনি সরে যেতে পারতেন। বলতে পারতেন যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়ন একজন ডাক্তারের কাজ নয়। তা না করে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইসব রোগ নির্মূল করার কাজে নেমে পড়লেন। সারা জীবন ধরে রয়ে গেলেন তাদের ভালমন্দে। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হল যৌনকর্মীদের মর্যাদার লড়াই। ... ...
দুর্বারের এ. জি. এম বা রিট্রিট যখন হতো লাঞ্চ ব্রেক - এ আমরা থালা হাতে খাবার লাইনে দাঁড়াতাম। উনিও তাই করতেন। সারাদিন যখন আলোচনা হচ্ছে, প্রেজেন্টেশন হচ্ছে তখন উনি এক রকম, আবার সেই মানুষটাই মিটিং এর বাইরে যখন দেশ-বিদেশের কথা বলতেন তখন একেবারে খুব কাছের বন্ধুর মতো কথা বলতেন। একটা জিনিস খুব অবাক করতো আমাদের। সমস্ত বিষয়ে ওনার অবাধ বিচরণ অর্থাৎ বিজ্ঞানে যতটা দক্ষ ততোটাই ইতিহাস-ভূগোল সমাজতত্ত্ব সব বিষয়ে। যৌনকর্মী দিদিদের প্রতি যে মমত্ব ওনার দেখেছি তা ভোলবার নয়। একজন নেত্রীর অপারেশনের সময় সস্ত্রীক সারাদিন হাসপাতালে থেকেছেন। আবার কোন নেত্রী অসুস্থ হলে কিভাবে কোনো ভালো জায়গা থেকে তাকে সুস্থ করা যাবে তার চেষ্টা করেছেন সব সময়। ... ...
যে জনসমাজের জন্য দুর্বার তা যাতে তাঁরাই দেখভাল করতে পারেন, অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর দ্বারাই পরিচালিত হয় তাঁদের সংগঠন সে বিষয়ে প্রথম থেকেই ছিলেন তৎপর। এখন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দ্বারা যৌনকর্মীরা তাঁদের মধ্য থেকে সচিব, সভাপতি ইত্যাদি নির্বাচিত করেন। ভোট হয় সেখানে, যৌনকর্মীদের নিজস্ব ভোট। পৃথিবীর ইতিহাসে যা যথেষ্ট ব্যতিক্রমি বলা যায়। যৌনকর্মীদের অর্জিত অর্থ যাতে সঞ্চিত থাকে, সুরক্ষিত থাকে তার জন্য সমবায় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আর এক ইতিহাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্নাতক এবং গণস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা মানুষ হয়েও ডাঃ জানা এবিষয়ে তৎপর হন। যৌনকর্মীদের সমবায় ব্যাঙ্ক আদৌ হওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তুমুল বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০-এর মাঝামাঝি আইনের কিছু অংশের পরিবর্তন করতে হয়। দুর্বার অনুমতি পায়। ... ...
আমরা এই মেয়েদের ঘৃণা করি, সমাজের পাঁক বলে ভাবি। ডাক্তারবাবু আর তাঁর দুর্বার মহিলা সমণ্বয় কমিটি মাত্র ২৪ বছরের সময়সীমায় আমাদের এই নজর অনেক পাল্টেছিলেন। নারী, মা এবং মানুষ, যৌনকর্মী জীবনের এই তিন অধ্যায় নিয়ে গুরুতে এবং অন্য জায়গাতেও অনেক লিখেছি। ডাক্তারবাবুর সদিচ্ছায় ব্যক্তিগত ভাবে এই লড়াইকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছি। তাই আমি এই নারীদের অত্যন্ত সমীহ করি। আদ্যন্ত লড়াকু না হলে এইরকম একটি নিষ্ঠুরতম পেশায় টিঁকে থাকা অসম্ভব, আরো অসম্ভব সমমনাদের নিয়ে এইরকম একটি সংগঠনে সামিল হওয়া ও তাকে এইভাবে সফল করে তোলা। ... ...
দুটি সমকামী ছেলের আত্মহত্যা করার ঘটনা নিয়ে কপি-পেস্ট করার মত আবেগ (এবং হ্যাশট্যাগ) বাজারে ছাড়া যায় না। ওটা নিয়ে আমরা চায়ের টেবিলে আলোচনা করতে পারি না যে। আর মাস হিস্টিরিয়ার উপাদান তো নেইই। আবেগ আর ভাবাবেগ ঠিক এক জিনিস নয়। আবেগটা নিজের ভিতর থেকে আসে। দ্বিতীয়টা অনেকটা গড্ডলিকাপ্রবাহের মত। একটা ধর্ষণের ঘটনার পর প্রচুর লোক আছে যারা "ডেথ পর রেপিস্ট" বলে হ্যাশট্যাগ দেয়। যাদের দায়বদ্ধতা থাকার কথা - সরকার, পুলিশ, আইনব্যবস্থা- এরাও কিন্তু চায় একটা সহজ ভাবাবেগ নিয়ে মানুষ মেতে থাকুক- কারণ খুঁটিনাটি সংস্কার অনেক সময়সাপেক্ষ, সংসাধনসাপেক্ষ কাজ। যেসব বিষয় নিয়ে গোষ্ঠী-আবেগ, ভাবাবেগ এগুলো জাগানো যায় না সেগুলো কম মনোযোগ পায়। ... ...
কিন্তু এত খাপছাড়া নিত্যনতুন সৃষ্টির সমাহারে বেচারা মানবকূল একেবারে থৈ পায় না। নিজেদের ক্ষুদ্র সীমায়, সীমিত বোধের ছাঁচে সবকিছুকে ফেলে তবে নিশ্চিন্ত বোধ করে। এই অজ্ঞান জাতির বোধে এটুকু কুলোয় না যে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের একটা আঙ্গুলের ছাপও যেখানে মেলে না, সেখানে কোনো একজন গোটা মানুষকে বেশীরভাগের মতো করে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হীন মুর্খামো ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেই যাঁরা বেঁধে-ছেঁদে ফুল-বাতাসায় নামিয়ে এনে কেবল স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্রে পরিণত করেছে, সেখানে তাঁর সামান্য সৃষ্টি আর কত মর্যাদা আশা করতে পারে...! আমরা যাঁরা অন্তরাত্মার আহ্বান শুনে নিয়ম-নিগরের তোয়াক্কা না করে সগর্বে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিই, তাঁরাই এই মানবসভ্যতার কাছে বেখাপ্পা, অদ্ভুতুড়ে, কিম্ভুতকিমাকার এক মুর্তিমান দ্রীঘাংচু। ... ...
অনেক ভেবেও অঙ্কটা মেলাতে পারেনা ও। ছোট থেকেই আর পাঁচটা ছেলের থেকে ও একটু আলাদা। সবাই যখন খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াত, ও তখন ঘরে বসে ছবি আঁকত নয়ত গান শুনত। ঠাম্মা বলত, সমু আমাদের লক্ষ্মী ছেলে ... ...
আর তার সাথে মনের ভেতর খচখচ করছে আরেকটা প্রশ্ন। গত তিন দশকের লাগাতার লড়াইয়ের শেষে ৩৭৭-এর প্রশ্নে দেশ এগোলো ঠিকই কিন্তু একই সময়কালে কি পিছিয়ে পড়ল না আরও অন্যান্য মানবাধিকারের ক্ষেত্রে? আমরা কি তিন দশক আগে ভাবতে পেরেছিলাম একের পর এক রাজ্য খাদ্যাভ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসাবে? আন্তঃধর্মীয় প্রেমকে আদালতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সেটা জিহাদ নয়? খাস কলকাতার বুকে আলিঙ্গনের অপরাধে গনপিটুনির শিকার হবেন যুবক-যুবতী? ট্রেনের কামরায় প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে না পারায় প্রহৃত হবেন দরিদ্র যুবক? গোরক্ষার নামে দেশ জুড়ে মানুষ খুন হবে? আর সেই খুনিদের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানাবেন দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? সরকার বিরোধী ইন্টেলেকচুয়ালস ও অ্যাক্টিভিস্টদের নামের লিস্ট তৈরী হবে যেমন হয়েছিল নাজি জার্মানিতে বা পাকিস্তান অধিকৃত বাংলাদেশে? একটা গোটা রাজ্যের নাগরিকদের প্রমাণ দাখিল করতে হবে যে তাঁরা "ঘুসপেটিয়া" নন? ... ...
এইসবের মাঝখানে পড়ে আমার ভাবনাচিন্তারা সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকল। মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা শুরু হল, সত্যিই কি এই বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের বিরূদ্ধে আন্দোলন হাত ধরাধরি করে চলতে পারে? কি ভাবে ক্যুইর আন্দোলনে একজন বামপন্থী (মতান্তরে ভাম্প্যান্টি) ও একজন দক্ষিনপন্থীর (মতান্তরে ভক্ত চাড্ডীর) সহাবস্থান হতে পারে? যখন সমকামী আন্দোলনের জন্য কথা বলছি তখন কি আমার অন্য রাজনৈতিক/সামাজিক পরিচয়টাকে সরিয়ে রাখতে হবে? তখন আমার শুধু একমাত্রিক পরিচয়, আমি একজন সমকামি? কিন্ত তাহলে, যে ঘেটোর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন, সে গন্ডীই কি নিজের চারিদিকে টেনে নিচ্ছি না আমি? আবার লিঙ্গ-আন্দোলনকে যদি ডান-বামে ভাগ করি, তাহলে কি শক্তিক্ষয় করছি না নিজেদের? "মিনিস্কিয়ুল মাইনরিটি" কি আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে না? যদি দেখি ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শোভা পাচ্ছে স্পন্সর অনুপম খেরের কাট আউট, যিনি আমার মতে জে এন ইউ ইস্যুতে বাকস্বাধীনতার কন্ঠরোধ করতে চেয়েছিলেন, তখন কি করব? যেহেতু ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তাই তার সঙ্গে থাকব, না কি সরে আসব, আর না কি অপছন্দটাকে যথাস্থানেভ্য জানিয়ে রেখে চুপচাপ বসে যাব? আর না কি সন্ত টেরেসার মত বলব, টাকায় কোনও দাগ নেই? টাকা কোথা থেকে এল গুরুত্বপূর্ণ নয়, কি কাজে খরচ হল সেটাই আসল? ... ...